একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে কবিতা ২০২৪

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে নিহতদের স্মরণ করা হয়। এই দিনটি বাংলা ভাষা আন্দোলনের স্মরণে পালিত হয় এবং এটি বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে একটি মূল ভূমিকা পালন করেছে। ২১ শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দিবসগুলির মধ্যে একটি, এটি একটি সরকারি ছুটির দিন ও সারা দেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালিত হয়। ঢাকায়, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে একটি জাতীয় স্মরণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানে রয়েছে শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভা। নিচে একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে কবিতা গুলো দেওয়া আছে।

একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে কবিতা

অমর একুশে
হাসান হাফিজুর রহমান

আম্মা তাঁর নামটি ধরে একবারও ডাকবে না তবে আর?
র্ঘূূণি ঝড়ের মতো সেই নাম উম্মথিত মনের প্রান্তরে
ঘুরে ঘুরে জাগবে, ডাকবে,
দুটি ঠোঁটের ভেতর থেকে মুক্তোর মতো গড়িয়ে এসে
একবারও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে না, সারাটি জীবনেও না? তবে হার?
কি করে এই গুরুভার সইবে তুমি, কতোদিন?
আবুল বরকত নেই: সেই অস্বাভাবিক বেড়ে ওঠা
বিশাল শরীর বালক, মধুর স্টলের ছাদ ছুঁয়ে হাঁটতো যে
তাঁকে ডেকো না;
আর একবারও ডাকলে ঘৃণায় তুমি কুঁচকে উঠবে-
সালাম, রফিক উদ্দিন, জব্বার-কি বিষণ্ন থোকা থোকা নাম;
এই এক সারি বর্শার তীক্ষ ফলার মতো এখন হৃদয়কে হানে
বিচ্ছেদের জন্য তৈরী হওয়ার আগেই
আমরা ওদেরকে হারিয়েছি-
কেননা, প্রতিক্রিয়ার গ্রাস জীবন ও মনুষ্যত্বকে সমীহ করে না;
ভেবে ওঠার আগেই আমরা ওদেরকে হারিয়েছি
কেননা, প্রতিক্রিয়ার কৌশল এক মৃত্যু দিয়ে হাজার মৃত্যুকে ডেকে আনে।
আর এবার আমরা হারিয়েছি এমন কয়েকজনকে
যাঁরা কোনদিন মন থেকে মুছবে না,
কোনদিন কাউকে শান্ত হতে দিবে না;
যাঁদের হারালাম তাঁরা আমাদেরকে বিস্তৃত করে দিয়ে গেল
দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, কথা কণা করে ছড়িয়ে দিয়ে গেল
দেশের প্রাণের দীপ্তির ভেতরে মৃত্যুর অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে।

একুশের কবিতা
আল মাহমুদ

ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায় ?
বরকতের রক্ত।

হাজার যুগের সূর্যতাপে
জ্বলবে এমন লাল যে,
সেই লোহিতেই লাল হয়েছে
কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে !

প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে
ছড়াও ফুলের বন্যা
বিষাদগীতি গাইছে পথে
তিতুমীরের কন্যা।

চিনতে না কি সোনার ছেলে
ক্ষুদিরামকে চিনতে ?
রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে
মুক্ত বাতাস কিনতে ?

পাহাড়তলীর মরণ চূড়ায়
ঝাঁপ দিল যে অগ্নি,
ফেব্রুয়ারির শোকের বসন
পরলো তারই ভগ্নী।

প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী
আমায় নেবে সঙ্গে,
বাংলা আমার বচন, আমি
জন্মেছি এই বঙ্গে।

কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি
মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী

এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে
রমনার উর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়
যেখানে আগুনের ফুলকির মতো
এখানে ওখানে জ্বলছে অসংখ্য রক্তের ছাপ
সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি।
আজ আমি শোকে বিহ্বল নই
আজ আমি ক্রোধে উন্মত্ত নই
আজ আমি প্রতিজ্ঞায় অবিচল।

যে শিশু আর কোনোদিন তার
পিতার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ার
সুযোগ পাবে না
যে গৃহবধূ আর কোনোদিন তার
স্বামীর প্রতিক্ষায় আঁচলে প্রদীপ
ঢেকে দুয়ারে আর দাঁড়িয়ে থাকবে না
যে জননী খোকা এসেছে বলে
উদ্দাম আনন্দে সন্তানকে আর
বুকে জড়িয়ে ধরতে পারবে না
যে তরুণ মাটির কোলে লুটিয়ে
পড়ার আগে বারবার একটি
প্রিয়তমার ছবি চোখে আনতে
চেষ্টা করেছিলো
সে অসংখ্য ভাইবোনদের নামে
আমার হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত
যে ভাষায় আমি মাকে সম্বোধনে অভ্যস্ত
সেই ভাষা ও স্বদেশের নামে
এখানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে
আমি তাদের ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি
যারা আমার অসংখ্য ভাইবোনকে
নির্বিচারে হত্যা করেছে।

ওরা চল্লিশজন কিম্বা আরো বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে রমনার রৌদ্রদগ্ধ
কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায়
ভাষার জন্য মাতৃভাষার জন্য বাংলার জন্য।
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে
একটি দেশের মহান সংস্কৃতির মর্যাদার জন্য
আলাওলের ঐতিহ্য
রবীন্দ্রনাথ, কায়কোবাদ, নজরুলের
সাহিত্য ও কবিতার জন্য

যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে
পলাশপুরের মকবুল আহমদের
পুঁথির জন্য
রমেশ শীলের গাথার জন্য,
জসীমউদ্দীনের ‘সোজন বাদিয়ার ঘাটের’ জন্য।

যারা প্রাণ দিয়েছে
ভাটিয়ালি, বাউল, কীর্তন, গজল
নজরুলের “খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি
আমার দেশের মাটি।”
এ দুটি লাইনের জন্য
দেশের মাটির জন্য,
রমনার মাঠের সেই মাটিতে
কৃষ্ণচূড়ার অসংখ্য ঝরা পাপড়ির মতো
চল্লিশটি তাজা প্রাণ আর
অঙ্কুরিত বীজের খোসার মধ্যে
আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের অসংখ্য বুকের রক্ত।
রামেশ্বর, আবদুস সালামের কচি বুকের রক্ত
বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সেরা কোনো
ছেলের বুকের রক্ত।
আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের প্রতিটি রক্তকণা
রমনার সবুজ ঘাসের উপর
আগুনের মতো জ্বলছে, জ্বলছে আর জ্বলছে
এক একটি হীরের টুকরোর মতো
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছেলে চল্লিশটি রত্ন
বেঁচে থাকলে যারা হতো
পাকিস্তানের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ
যাদের মধ্যে লিংকন, রঁল্যা,
আরাগঁ, আইনস্টাইন আশ্রয় পেয়েছিল
যাদের মধ্যে আশ্রয় পেয়েছিল
শতাব্দীর সভ্যতার
সবচেয়ে প্রগতিশীল কয়েকটি মতবাদ,
সেই চল্লিশটি রত্ন যেখানে প্রাণ দিয়েছে
আমরা সেখানে কাঁদতে আসিনি।
যারা গুলি ভরতি রাইফেল নিয়ে এসেছিল ওখানে
যারা এসেছিল নির্দয়ভাবে হত্যা করার আদেশ নিয়ে
আমরা তাদের কাছে
ভাষার জন্য আবেদন জানাতেও আসিনি আজ।
আমরা এসেছি খুনি জালিমের ফাঁসির দাবি নিয়ে।

আমরা জানি তাদের হত্যা করা হয়েছে
নির্দয়ভাবে ওদের গুলি করা হয়েছে
ওদের কারো নাম তোমারই মতো ‘ওসমান’
কারো বাবা তোমারই বাবার মতো
হয়তো কেরানি, কিংবা পূর্ব বাংলার
নিভৃত কোনো গাঁয়ে কারো বাবা
মাটির বুক থেকে সোনা ফলায়
হয়তো কারো বাবা কোনো
সরকারি চাকুরে।
তোমারই আমারই মতো,
যারা হয়তো আজকে বেঁচে থাকতে পারতো,
আমারই মতো তাদের কোনো একজনের
হয়তো বিয়ের দিনটি পর্যন্ত ধার্য হয়ে গিয়েছিল,
তোমারই মতো তাদের কোনো একজন হয়তো
মায়ের সদ্যপ্রাপ্ত চিঠিখানা এসে পড়বার আশায়
টেবিলে রেখে মিছিলে যোগ দিতে গিয়েছিল।

এমন এক একটি মূর্তিমান স্বপ্নকে বুকে চেপে
জালিমের গুলিতে যারা প্রাণ দিল
সেইসব মৃত্যুর নামে
আমি ফাঁসি দাবি করছি।

যারা আমার মাতৃভাষাকে নির্বাসন দিতে
চেয়েছে তাদের জন্যে
আমি ফাঁসির দাবি করছি।
যাদের আদেশে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে তাদের জন্য
ফাঁসি দাবি করছি
যারা এই মৃতদেহের উপর দিয়ে
ক্ষমতার আসনে আরোহণ করেছে
সেই বিশ্বাসঘাতকদের জন্য।
আমি ওদের বিচার দেখতে চাই
খোলা ময়দানে সেই নির্দিষ্ট জায়গাতে
শাস্তিপ্রাপ্তদের গুলিবিদ্ধ অবস্থায়
আমার দেশের মানুষ দেখতে চায়।
পাকিস্তানের প্রথম শহীদ
এই চল্লিশটি রত্ন,
দেশের চল্লিশ জন সেরা ছেলে
মা, বাবা, বৌ, আর ছেলে নিয়ে
এই পৃথিবীর কোলে এক একটি
সংসার গড়ে তোলা যাদের
স্বপ্ন ছিলো।
যাদের স্বপ্ন ছিল আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে
আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার,
যাদের স্বপ্ন ছিল আণবিক শক্তিকে
কীভাবে মানুষের কাজে লাগানো যায়
শান্তির কাজে লাগানো যায়।
তার সাধনা করার।
যাদের স্বপ্ন ছিল-রবীন্দ্রনাথের
‘বাঁশিওয়ালার’ চেয়েও সুন্দর
একটি কবিতা রচনা করার,
সেই সব শহীদ ভাইয়েরা আমার
যেখানে তোমরা প্রাণ দিয়েছ
সেখানে হাজার বছর পরেও
সেই মাটি থেকে তোমাদের রক্তাক্ত চিহ্ন
মুছে দিতে পারবে না সভ্যতার কোনো পদক্ষেপ।
যদিও অসংখ্য মিছিল অস্পষ্ট নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করবে একদিন
তবুও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ঘণ্টা ধ্বনি
প্রতিদিন তোমাদের ঐতিহাসিক মৃত্যুক্ষণ ঘোষণা করবে।
যদিও আগামীতে কোন ঝড়-ঝঞ্ঝা বিশ্ববিদ্যালয়ের
ভিত্তি পর্যন্ত নাড়িয়ে দিতে পারে
তবুও তোমাদের শহীদ নামের ঔজ্জ্বল্য
কিছুতেই মুছে যাবে না।

খুনী জালিমের নিপীড়নকারী কঠিন হাত
কোনোদিনও চেপে দিতে পারবে না
তোমাদের সেই লক্ষদিনের আশাকে,
যেদিন আমরা লড়াই করে জিতে নেবো
ন্যায়-নীতির দিন
হে আমার মৃত ভায়েরা,
সেই দিন নিস্তব্ধতার মধ্য থেকে
তোমাদের কণ্ঠস্বর
স্বাধীনতার বলিষ্ঠ চিৎকারে
ভেসে আসবে
সেই দিন আমার দেশের জনতা
খুনি জালিমকে ফাঁসির কাষ্ঠে
ঝুলাবেই ঝুলাবে
তোমাদের আশা অগ্নিশিখার মতো জ্বলবে
প্রতিশোধ এবং বিজয়ের আনন্দে।

শেষ কথা

একুশে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে আরও অনেক কবি কবিতা লিখেছেন। সেই সকল কবিতার মধ্যে কেকটি কবিতা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এই পোস্টে সেই কবিতা গুলো শেয়ার করা হয়েছে। আশা করছি একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে কবিতা গুলো পড়েছেন।

আরও দেখুনঃ

২১শে ফেব্রুয়ারি নিয়ে উক্তি ও ছন্দ ২০২৪

২১শে ফেব্রুয়ারি মহান মাতৃভাষা দিবসের স্লোগান ২০২৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *