এই পোস্টে সুখী মানুষ গল্প টি দেওয়া আছে। ‘সুখী মানুষ’ নাটিকাটি একজন অত্যাচারী মােড়লের কাহিনি নিয়ে রচিত । মােড়ল মানুষকে ঠকিয়ে, মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে ধনী হয়েছে। সে এখন অসুস্থ। তার মনে শান্তি নেই। চিকিৎসক বলেছেন, কোনাে সুখী মানুষের জামা গায়ে দিলেই শুধু মােড়লের অসুস্থতা কেটে যাবে। কিন্তু পাঁচ গ্রাম খুজেও একজন সুখী মানুষ পাওয়া গেল না। নিচে থেকে সুখী মানুষ গল্পের মূলভাব ও সম্পূর্ণ গল্প টি পড়ুন।
সুখী মানুষ
[মোড়লের অসুখ। বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে। কবিরাজ মোড়লের নাড়ি পরীক্ষা করছে। মোড়লের আত্মীয় হাসু মিয়া আর মোড়লের বিশ্বাসী চাকর রহমত আলী অসুখ নিয়ে কথা বলছে।]
(৪২)
হাসু : রহমত, ও রহমত আলী।
রহমত : শুনছি।
হাসু : ভালো করে শোনো, ঐ কবিরাজ যতই নাড়ি দেখুক, তোমার মোড়লের নিস্তার নাই।
রহমত : অমন ভয় দেখাবেন না। তাহলে আমি হাউমাউ করে কাঁদতে লেগে যাব।
হাসু : কাঁদ, মন উজাড় করে কাঁদ। তোমার মোড়ল একটা কঠিন লোক। আমাদের সুবর্ণপুরের মানুষকে বড় জ্বালিয়েছে। এর গরু কেড়ে, তার ধান লুট করে তোমার মোড়ল আজ ধনী। মানুষের কান্না দেখলে হাসে।
রহমত : তাই বলে মোড়লের ব্যারাম ভালো হবে না কেন?
হাসু : হবেই না তো। মোড়ল যে অত্যাচারী, পাপী। মনের মধ্যে অশামিত থাকলে ঔষুধে কাজ হয় না। দেখে নিও, মোড়ল মরবে।রহমত : আর আজে-বাজে কথা বলবেন না। আপনি বাড়ি যান!
কবিরাজ : এত কোলাহল করো না। আমি রোগীর নাড়ি পরীক্ষা করছি।
রহমত : ও কবিরাজ, নাড়ি কী বলছে! মোড়ল বাঁচবে তো!
কবিরাজ : মূর্খের মতো কথা বল না। মানুষ এবং প্রাণী অমর নয়। আমি যা বলি মনোযোগ দিয়ে তাই শ্রবণ কর।
হাসু : আমাকে বলুন। মোড়ল আমার মামাতো ভাই।
রহমত : মোড়ল আমার মনিব।
কবিরাজ : এই নিষ্ঠুর মোড়লকে যদি বাঁচাতে চাও, তাহলে একটি কঠিন কর্ম করতে হবে।
হাসু : বাঘের চোখ আনতে হবে?
কবিরাজ : আরও কঠিন কাজ।
রহমত : হিমালয় পাহাড় তুলে আনব?
কবিরাজ : পাহাড়, সমুদ্র, চন্দ্র, নক্ষত্র কিছুই আনতে হবে না।
মোড়ল : আর সহ্য করতে পারছি না। জ্বলে গেল। হাড় ভেঙে গেল। আমাকে বাঁচাও।
কবিরাজ : শান্ত হও। ও রহমত, মোড়লের মুখে শরবত ঢেলে দাও।
(রহমত মোড়লকে শরবত দিচ্ছে)
হাসু : ঐ মোড়ল জোর করে আমার মুরগি জবাই করে খেয়েছে। আমি আজ মুরগির দাম নিয়ে ছাড়ব।
মোড়ল : ভাই হাসু এদিকে এস, আমি সব দিয়ে দেব। আমাকে শান্তি এনে দাও।
কবিরাজ : মোড়ল, তুমি কি আর কোনোদিন মিথ্যা কথা বলবে?
মোড়ল : আর বলব না। এই তোমার মাথায় হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করছি, আর কোনোদিন মানুষের ওপর জবরদস্তি করব না। আমাকে ভালো করে দাও।
কবিরাজ : লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। আর কোনোদিন লোভ করবে?
মোড়ল : না। লোভ করব না, অত্যাচার করব না আমাকে শান্তি দাও। সুখ দাও।
কবিরাজ : তাহলে মনের সুখে শুয়ে থাক, আমি ওষুধের কথা চিন্তা করি।
মোড়ল : সুখ কোথায় পাব? আমাকে সুখ এনে দাও।
হাসু : অন্যের মনে দুঃখ দিলে কোনোদিন সুখ পাবে না।
(৪৩)
মোড়ল : আমার কত টাকা, কত বড় বাড়ি! আমার মনে দুঃখ কেন?
কবিরাজ : চুপ কর। যত কোলাহল করবে তত দুঃখ বাড়বে। হাসু এদিকে এস, আমার কথা শ্রবণ কর। মোড়লের ব্যামো ভালো হতে পারে, যদি…..
রহমত : যদি কী?
কবিরাজ : যদি আজ রাত্রির মধ্যেই-
হাসু : কী করতে হবে?
কবিরাজ : যদি একটি ফতুয়া সংগ্রহ করতে পার।
রহমত : ফতুয়া?
কবিরাজ : হ্যাঁ, জামা। এই জামা হবে একজন সুখী মানুষের। তার জামাটা মোড়লের গায়ে দিলে, তৎক্ষণাৎ তার হাড় মড়মড় রোগ ভালো হবে।
রহমত : এ তো খুব সোজা ওষুধ।
কবিরাজ : সোজা নয়, খুব কঠিন কাজ। যাও, সুখী মানুষকে খুঁজে দেখ। সুখী মানুষের জামা না হলে অসুখী মোড়ল বাঁচবে না।
মোড়ল : আমি বাঁচব। জামা এনে দাও, হাজার টাকা বখশিশ দেব।
(দ্বিতীয় দৃশ্য)
[বনের ধারে অন্ধকার রাত। চাঁদের ম্লান আলো। ছোট একটি কুঁড়েঘরের সামনে হাসু মিয়া ও রহমত গালে হাত দিয়ে ভাবছে।]
রহমত : কী তাজ্জব কথা, পাঁচ গ্রামে এক জনও সুখী মানুষ পেলাম না। যাকেই ধরি, সেই বলে, না ভাই, আমি সুখী নই।
হাসু : আর তো সময় নাই ভাই, এখন বারটা। সুখী মানুষ নাই, সুখী মানুষের জামাও নাই। মোড়ল তো তাহলে এবার মরবে।
রহমত : আহা রে, আমরা এখন কী করব! কোথায় একটা মানুষ পাব, যে কিনা..
হাসু : পাওয়া যাবে না। সুখী মানুষ পাওয়া যাবে না। সুখ বড় কঠিন জিনিস। এ দুনিয়াতে ধনী বলছে, আরও ধন দাও, ভিখারি বলছে, আরও ভিক্ষা দাও, পেটুক বলছে, আরও খাবার দাও। শুধু দাও আর দাও। সবাই অসুখী। কারও সুখ নেই।
রহমত : আমরাও বলছি, মোড়লের জন্য জামা দাও, আমাদের বখশিশ দাও। আমরাও অসুখী।
হাসু : চুপ চুপ! ঘরের মধ্যে কে যেন কথা বলছে।
রহমত : ভূত নাকি? চলেন, পালিয়ে যাই। ধরতে পারলে মাছ ভাজা করে খাবে।
হাসু : এই যে, ভাই। ঘরের মধ্যে কে কথা বলছ? বেরিয়ে এস।
রহমত : ভূতকে ডাকবেন না।
[ঘর থেকে একজন লোক বেরিয়ে এলো।]
লোক : তোমরা কে ভাই? কী চাও?
হাসু : আমরা খুব দুঃখী মানুষ। তুমি কে?
লোক : আমি একজন সুখী মানুষ।
হাসু : আঁ! তোমার কোন দুঃখ নাই?
(৪৪)
লোক : না। সারা দিন বনে বনে কাঠ কাটি। সেই কাঠ বাজারে বেচি। যা পাই, তাই দিয়ে চাল কিনি, ডাল কিনি। মনের সুখে খেয়ে দেয়ে গান গাইতে গাইতে শুয়ে পড়ি। এক ঘুমেই রাত কাবার।
হাসু : বনের মধ্যে একলা ঘরে তোমার ভয় করে না? যদি চোর আসে?
লোক : চোর আমার কী চুরি করবে?
হাসু : তোমার সোনাদানা, জামা জুতা?
[লোকটি প্রাণখোলা হাসি হাসছে]
রহমত : হা হা করে পাগলের মতো হাসছ কেন ভাই!
লোক : তোমাদের কথা শুনে হাসছি। চোরকে তখন বলব, নিয়ে যাও, আমার যা কিছু আছে নিয়ে যাও।
হাসু : তুমি তাহলে সত্যিই সুখী মানুষ।
লোক : দুনিয়াতে আমার মতো সুখী কে? আমি সুখের রাজা। আমি মস্ত বড় বাদশা।
রহমত : ও বাদশা ভাই, তোমার গায়ের জামা কোথায়? ঘরের মধ্যে রেখেছ? তোমাকে একশ টাকা দেব। জামাটা নিয়ে এস।
লোক : জামা!
রহমত : জামা মানে জামা! এই যে, আমাদের এই জামার মতো জিনিস। তোমাকে পাঁচশ টাকা দেব। জামাটা নিয়ে এস, মোড়লের খুব কষ্ট হচ্ছে।
লোক : আমার তো কোনো জামা নাই ভাই!
হাসু : মিছে কথা বল না।
লোক : মিছে বলব কেন? আমার ঘরে কিছু নাই। সেই জন্যই তো আমি সুখী মানুষ।
সুখী মানুষ গল্পের মূলভাব
‘সুখী মানুষ’ নাটিকাটি একজন অত্যাচারী মােড়লের কাহিনি নিয়ে রচিত । মােড়ল মানুষকে ঠকিয়ে, মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে ধনী হয়েছে। সে এখন অসুস্থ। তার মনে শান্তি নেই। চিকিৎসক বলেছেন, কোনাে সুখী মানুষের জামা গায়ে দিলেই শুধু মােড়লের অসুস্থতা কেটে যাবে। কিন্তু পাঁচ গ্রাম খুজেও একজন সুখী মানুষ পাওয়া গেল না।অবশেষে একজনকে পাওয়া গেল , যে নিজের শ্রমে উপার্জিত আয় দিয়ে কোনােভাবে জীবিকা নির্বাহ করে সুখে দিনাতিপাত করছে। সে সুখে ঘুমাতে পারে, কারণ তার কোনাে সম্পদ নেই। ফলে তার কোনাে চোরের ভয় নেই।
সে একজন প্রকৃত সুখী মানুষ। কিন্তু মুশকিল হলাে এই সুখী মানুষের কোনাে জামা নেই। অতএব মােড়লের সমস্যার সমাধান হলাে না। এখানে লেখকের বক্তব্য স্পষ্ট যে, অন্যায় ও অনৈতিকভাবে উপার্জিত অর্থ বিত্তই মানুষের অশান্তির মূল কারণ। সুখ একটা আপেক্ষিক ব্যাপার । একজনের অনেক সম্পদ থেকেও সুখ নেই।আবার আরেকজনের কিছু না থাকলেও সে সুখী থাকতে পারে । সৎ পথে পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করলেই জীবনে শান্তি মেলে।
শেষ কথা
আশা করছি এই পোস্ট আপনাদের ভালোলেগেছে এবং এখান থেকে আমাদের লোকশিল্প গল্প টি পড়তে পেরেছেন। এই রকম শিক্ষাসংক্রান্ত তথ্য পেতে আমার সাথেই থাকুন। এই ওয়েবসাইটে শিক্ষামূলক পোস্ট শেয়ার করা হয়।
আরও দেখুনঃ
আমাদের লোকশিল্প -কামরুল হাসান। বাংলা ১ম পত্র